যার নিখুত সৃষ্টি কুশলতায় অস্তিত্ব লাভ করেছে এ বিশ্ব জাহান। যার অসীম কুদরতের অনুপম নিদর্শন চাঁদ-সুরুজ ও সিতারা-আসমান। যার করুণা স্নিগ্ধ লালন-প্রতিপালনে ধন্য সকল জড় উদ্ভিদ প্রাণ। সেই মহান রাব্বুল আলামীনের জন্যই আমার সকাল-সন্ধ্যার হামদ-সানা, আমার দিবস রজনীর স্তুতি-বন্দনা।
যার শুভাগমনে আঁধার ঘুচে মানবতার পূর্ব দিগন্তে এক নতুন সূর্যের উদয় হল। মানবতার মুক্তির জন্য মানুষেরই হাতে তায়েফের মাটি যার রক্তে রঞ্জিত হল; সেই নবী রাহমাতুল্লিল আলামীনের প্রতি আমার বিরহী আত্মার সালাত ও সালাম। মদীনা স্বপ্নে বিভোর আমার হৃদয়ের প্রেম-পয়গাম।
মানুষ স্বপ্ন দেখে। ভাল স্বপ্ন দেখে, বলে সুন্দর স্বপ্ন দেখেছি। দেখে খারাপ স্বপ্ন, বলে ভয়ানক এক স্বপ্ন দেখেছি। আবার কখনো বলে একটি বাজে স্বপ্ন দেখেছি।
আসলে স্বপ্ন কি? এ নিয়ে গবেষণা কম হয়নি, মানব সভ্যতার শুরু থেকে আজ পর্যন্ত। কেউ বলেছেন, এটা একটি মানসিক চাপ থেকে আসে। কেউ বলেছেন, শারীরিক বিভিন্ন ভারসাম্যের ব্যাঘাত ঘটলে এটা দেখা যায়, সে অনুযায়ী। কেউ বলেছেন, সারাদিন মনে যা কল্পনা করে তার প্রভাবে রাতে স্বপ্ন দেখে।
স্বপ্ন আধুনিক মনোবিজ্ঞানেরও একটি বিষয়।
আবার অনেকে স্বপ্ন না দেখেও বলে এটা আমার স্বপ্ন ছিল। অথবা আমার জীবনের স্বপ্ন এ রকম ছিল না। মানে, মনের আশা, পরিকল্পনা। তাই স্বপ্নের অর্থ এখানে রূপক।
আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে মানুষের জন্য পরিপূর্ণ জীবন ব্যবস্থা হিসাবে এসেছে ইসলাম। এই ইসলাম মানুষের স্বপ্নের ব্যাপারেও উদাসীন থাকেনি। স্বপ্ন সম্পর্কে তার একটি নিজস্ব বক্তব্য আছে। তার এ বক্তব্য কোনো দার্শনিক বা বিজ্ঞানীর বক্তব্যের সাথে মিলে যাবে, এমনটি জরুরী নয়। মিলে গেলেও কোনো দোষ নেই।
স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা বিশেষজ্ঞ ইমাম মুহাম্মাদ ইবনে সীরিন রহ. বলেছেন :
الرؤيا ثلاث : حديث النفس ، وتخويف الشيطان ، وبشرى من الله .
(رواه البخاري في التعبير)
স্বপ্ন তিন ধরনের হয়ে থাকে। মনের কল্পনা ও অভিজ্ঞতা। শয়তানের ভয় প্রদর্শন ও কুমন্ত্রণা ও আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে সুসংবাদ। (বর্ণনায় : বুখারী)
ইসলামে স্বপ্নের একটি গুরুত্ব আছে। নি:সন্দেহে এটা ইসলামী জ্ঞান-বিজ্ঞানের একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
এক চোখা বস্তুবাদীরা বলে থাকে, মানুষ যখন ঘুমায়, তখন তার মস্তিস্ক তার স্মৃতিগুলো নাড়াচাড়া করে। যাচাই-বাছাই করে, কিছু পুনর্বিন্যাস করে। তারপর স্মৃতির ফাইলে যত্ন করে রেখে দেয়। এই কাজটা সে করে মানুষ যখন ঘুমিয়ে থাকে তখন। মস্তিস্কের এই কাজ-কর্মই আমাদের কাছে ধরা দেয় স্বপ্ন হিসেবে।”
কথাটা শুনতে মন্দ নয়। তবে এটি স্বপ্নের একটি প্রকার মাত্র। বাকী দু প্রকার কি আপনাদের মস্তিস্কে ধরা পড়ে? ইসলাম তো বলে স্বপ্ন তিন প্রকার।
হাদীসে দেখা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ফজরের নামাজের পর মুসল্লীদের দিকে মুখ করে বসতেন। প্রায়ই জিজ্ঞেস করতেন, গত রাতে তোমাদের কেউ কি কোনো স্বপ্ন দেখেছ?
আল-কোরআনে নবী ইবরাহীম আলাইহিস সালামের স্বপ্ন, ইউসুফ আলাইহিস সালামের স্বপ্নের কথা উল্লেখ আছে। ইউসূফ আলাইহিস সালামের সময়ে মিশরের বাদশার স্বপ্ন, তাঁর জেলখানার সঙ্গীদের স্বপ্ন ও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের স্বপ্ন নিয়ে তো আল কোরআনে বিস্তর আলোচনা হয়েছে।
মিশরের বাদশা তার সভাসদের স্বপ্ন বিশেষজ্ঞদেরকে নিজ স্বপ্ন সম্পর্কে প্রশ্ন করেছিল। জানতে চেয়েছিল, সেই স্বপ্নের ব্যাখ্যা। তারা বলেছিল, এটা এলোমেলো অলীক স্বপ্ন। তারা এর ব্যাখ্যা দিতে পারল না।
নবী ইউসুফ আলাইহিস সালাম এর সুন্দর ব্যাখ্যা দিলেন। নিজের পক্ষ থেকে নয়। আল্লাহ তাআলার শিখানো ইলম থেকে। (সূরা ইউসূফের ৩৬ থেকে ৪৯ আয়াত দ্রষ্টব্য)
স্বপ্ন দ্রষ্টার অবস্থা ভেদে একই স্বপ্নের ব্যাখ্যা বিভিন্ন রকম হতে পারে।
স্বপ্ন তিন প্রকার:
এক. মনে মনে যা সারাদিন কল্পনা করে তার প্রভাবে ঘুমের মধ্যে ভাল-মন্দ কিছু দেখা। এগুলো আরবীতে আদগাছু আহলাম বা অলীক স্বপ্ন বলে।
দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে স্বপ্ন দেখা। সাধারণত এ সকল স্বপ্ন ভীতিকর হয়ে থাকে।
তিন. আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে ইশারা, ইঙ্গিত হিসাবে স্বপ্ন দেখা।
বিষয়টি উপরে বর্ণিত হাদীসেও উল্লেখ হয়েছে।
হাদীসে এসেছে :
عن أبي هريرة رضي الله عنه قال: سمعت رسول الله صلى الله عليه وسلم يقول: "لم يبق من النبوة إلا المبشرات" قالوا: وما المبشرات؟ قال: "الرؤيا الصالحة" رواه البخاري.
في كتاب التعبير (باب المبشرات).
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেছেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-কে বলতে শুনেছি, তিনি বলেন, নবুওয়তে আর কিছু অবশিষ্ট নেই, বাকী আছে কেবল মুবাশশিরাত (সুসংবাদ)। সাহাবীগণ প্রশ্ন করলেন, মুবাশশিরাত কী? তিনি বললেন: ভাল স্বপ্ন।
(বর্ণনায় : সহীহ বুখারী)
এ হাদীস থেকে আমরা যা জানতে পারলাম:
এক. স্বপ্ন নবুওয়তের একটি অংশ। নবী ও রাসূলদের কাছে জিবরীল যেমন সরাসরি ওহী নিয়ে আসতেন, তেমনি স্বপ্নের মাধ্যমে আল্লাহ তাআলার নবী ও রাসূলদের কাছে প্রত্যাদেশ পাঠাতেন।
দুই. মুসলিম জীবনে স্বপ্ন শুধু একটি স্বপ্ন নয়। এটা হতে পারে মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে স্বপ্নদ্রষ্টার প্রতি একটি বার্তা।
তিন. আল মুবাশশিরাত অর্থ সুসংবাদ। সঠিক স্বপ্ন যা আল্লাহ তাআলার পক্ষ থেকে হয়ে থাকে, তা স্বপ্ন দ্রষ্টার জন্য একটি সুসংবাদ।
হাদীসে এসেছে
وعن أبي هريرة رضي الله عنه أن النبي صلى الله عليه وسلم قال: "إذا اقترب الزمان لم تكد رؤيا المؤمن تكذب، ورؤيا المؤمن جزء من ستة وأربعين جزءً من النبوة" متفق عليه،
وفي رواية: "أصدقكم رؤيا أصدقكم حديثاً".
الحديث رواه البخاري في التعبير (باب القيد في المنام) ومسلم في أول كتاب الرؤيا.
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, দিন যত যেতে থাকবে, কিয়ামত নিকটে হবে, মুমিনদের স্বপ্নগুলো তত মিথ্যা হতে দূরে থাকবে। ঈমানদারের স্বপ্ন হল নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের একভাগ।
(বর্ণনায় : বুখারী ও মুসলিম)
অন্য একটি বর্ণনায় এসেছে, তোমাদের মধ্যে যে লোক যত বেশী সত্যবাদি হবে তার স্বপ্ন তত বেশী সত্যে পরিণত হবে।
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. মুমিনের জীবনে স্বপ্ন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কেয়ামত যত নিকটে আসবে ঈমানদারের স্বপ্ন তত বেশী সত্য হতে থাকবে।
দুই. ঈমানদারের জীবনে স্বপ্ন এত গুরুত্ব রাখে যে, তাকে নবুওয়তের ছিচল্লিশ ভাগের এক ভাগ বলা হয়েছে।
তিন. মানুষ যত বেশী সততা ও সত্যবাদিতার চর্চা করবে সে ততবেশী সত্য স্বপ্ন দেখতে পাবে।
চার. যদি কেউ চায় সে সত্য স্বপ্ন দেখেব, সে যেন সৎ, সততা ও সত্যবাদিতার সাথে জীবন যাপন করে।
হাদীসে এসেছে
وعن أبي هريرة رضي الله عنه قال: قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : من رآني في المنام فسيراني في اليقظة -أو كأنما رآني في اليقظة- لا يتمثل الشيطان بي" متفق عليه.
الحديث رواه البخاري في التعبير (باب من رأى النبي صلى الله عليه وسلم في المنام) ومسلم في الرؤيا (باب قول النبي صلى الله عليه وسلم من رآني في المنام فقد رآني).
আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: যে নিদ্রার মধ্যে আমাকে দেখে সে যেন বাস্তবেই আমাকে দেখেছে। কারণ, শয়তান আমার আকৃতি ধারণ করতে পারে না। (বুখারী ও মুসলিম)
এ হাদীস থেকে আমরা জানতে পারলাম :
এক. যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে স্বপ্নে দেখবে সে সত্যিকারভাবেই তাকে দেখেছে।
দুই. শয়তানের কুমন্ত্রণা ও প্রভাবে মানুষ স্বপ্ন দেখে থাকে। শয়তান মানুষকে বিভিন্ন স্বপ্ন দেখাতে পারে। কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের আকৃতি ধরে ধোকা দিতে পারে না।
তিন. রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে স্বপ্নে দেখা একটি সৌভাগ্য। খুব কম ঈমানদারই আছেন, যারা এ সৌভাগ্যটি অর্জন করেছেন।